করোনায় চান্দিনা ‘হট স্পট’, দায়ভার কার?
শনিবার দুপুর থেকেই দেশের জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার অনলাইনসমূহে চান্দিনা উপজেলা নির্বাহী অফিসার স্নেহাশীষ দাস হোম কোয়ারিন্টিনে থাকার সংবাদ দেখার পর ভাবনা জমতে শুরু করলো মনের গহীনে। যে মানুষটি এ উপজেলার ‘করোনা প্যান্ডামিক’ মোকাবিলা করেছেন নিজের সেরাটা দিয়ে। সে মানুষটিই আজ সবার স্বার্থে আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমার দেখেছি, উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রান সহায়তা নিয়ে ছুটে গেছেন তিনি। আবার কখনোবা রাতের আঁধারে খাবার নিয়ে ছুটেছেন লজ্জায় বলতে না পারা নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং হতদরিদ্রের দুয়ারে। করোনা ভাইরাস মহামারির সময়ে চান্দিনার সর্ব স্তরের মানুষকে আগলে রাখার অগ্রনায়কদের মধ্যে তিনি একজন। আর তিনি কিনা এখন হোম কোয়ারিন্টিনে!
এদিকে উপজেলার ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ বাইক টিমের তদারকিতে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন ইউএনওর গাড়িচালক। তালিকা অনুযায়ী বাইকে খাবার প্যাকেট তুলে দেওয়া, সবাইকে মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লোবস বিতরণসহ অন্যান্য কাজে এই কর্মচারী সরাসরি সহায়তা করেছেন ‘মানবতার ফেরিয়ালা’র পুরো টিমকে। উপজেলা কার্যালয়ের অনেকের সাথে মিশে বিভিন্ন কার্যাবলি সম্পাদনেও ব্যাপক সহায়তা করেছেন তিনি। অথচ তিনি আজ করোনায় পজিটিভ! তার করোনায় পজিটিভ রিপোর্ট আসায় পুরো চান্দিনা উপজেলা প্রশাসন একরকম ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন। এক রকমের শঙ্কা তৈরি হয়েছে প্রত্যেকের মধ্যে। আমরা দেখেছি এ ঘটনার পর পরই চান্দিনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারিন্টিনে চলে গেছেন। এদিক বিবেচনায় অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
উপরোল্লেখিত ঘটনাসমূহ মনে কিঞ্চিৎ শঙ্কার জন্ম দিলেও পরে সেটা বেড়ে গেল বহুগুণে। রাত পেরিয়ে রোববার সকাল হলো। চান্দিনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ফেসবুক একাউন্ট থেকে এবার সতর্কবার্তা এলো ভয়াবহরূপে। বার্তাটা ছিল অনেকটা এমন- চান্দিনা বাজার, ধানসিঁড়ি আবাসিক এলাকা ও মহারং এলাকাকে ‘হট স্পট’ ঘোষণা করা হয়েছে। করোনায় চান্দিনা ‘হট স্পট! লেখাটা দেখেই কেন জানি হৃদপিন্ডে একটা মৃদু কম্পন সৃষ্টি হল।
কুমিল্লার ১৭ উপজেলার মধ্যে কেবল ‘দেবিদ্বার ও চান্দিনা’ উপজেলাকে করোনার রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করেছেন জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। এই দুই উপজেলায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় রেড জোন হিসেবে ধরা হয়েছে বলে জানান তারা। চান্দিনা উপজেলার মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৯ জন, মারা গেছেন ১ জন। সুস্থ হয়েছেন ৩ জন। বাকি ৫ জন আইসোলোশনে চিকিৎসা নিচ্ছেন। গত দুদিনে এ উপজেলায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে ৫ জন। এছাড়াও করোনা উপসর্গ নিয়ে এ উপজেলায় একজন কলেজ ছাত্রীর মৃত্যুর খবরও আমরা জানতে পেরেছি।
হঠাৎ করে চান্দিনা উপজেলা করোনায় রেড জোন হিসেবে পরিচিতি পাওয়ায় নতুন করে ভাবাচ্ছে উপজেলার সচেতন মহলকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জেলার প্রথম করোনায় রেড জোন হিসেবে খ্যাত দেবিদ্বার উপজেলা সংলগ্ন এলাকা থেকে চান্দিনায় করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। আর এ উপজেলার আজকের এই আশঙ্কাজনক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কি কেবল উপজেলার সীমান্তবর্তী দেবিদ্বার উপজেলার গ্রামসমূহ দায়ী? নাকি আমাদের সচেতনতা অথবা স্থানীয় প্রশাসন কিংবা জনপ্রতিনিধি?
আমরা দেখছি, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জোরালো নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তা মানছেন না এখানকার কেউ। উপজেলার পুরো ১৩টি ইউনিয়নসহ ১টি পৌরসভার মানুষকে ঘরে ফিরাতে যেসকল পদক্ষেপ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে তা মানছে না কেউ। উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ এক এরিয়ার মানুষজনদের ঘরে ফিরাতে গেলে অন্য এরিয়ার মানুষজন ঘর হতে বের হয়ে আসেন। আবার অন্য এরিয়ায় গেলে ঐ আগের এরিয়ার মানুষজন ঘর হতে বের হয়ে আসেন। এক ধরণের লুকোচুরি খেলা! জন সমাগম নিষিদ্ধের বরাত দিয়ে সরকারি বিভিন্ন নির্দেশনা থাকার পরও তা কেউ মানছেনা এখানকার কেউ। উপজেলার বিভিন্ন ব্যাংক শাখা থেকে শুরু করে এখানকার মসজিদগুলোতেও ব্যাপক লোকসমাগম সৃষ্টি হচ্ছে অনায়াসে। মসজিদগুলোতে তারাবিহ’র নামাজসহ অন্যান্য নামাজের জামায়াত পড়ানোর যে নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে, তা মানছেনা মসজিদ কমিটির নেতৃবৃন্দ। আবার কোথাও কোথাও মসজিদ কমিটির নেতৃবৃন্দের কড়া নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মুসল্লিরা তা মানতে নারাজ।
উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, হাট-বাজার ও দোকানপাটে লোক জমায়েত এর দৃশ্য সেই পুরোনো দৃশ্যের মত। সন্ধ্যার পর চায়ের দোকানে বসে আড্ডায় মাতোয়ারা সবাই। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আসার খবর শুনলে সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায় তাদের ওই দোকানপাট। বাহিনীর সদস্যরা চলে গেলে আবারো সেই আড্ডা! আবার কোথাও কোথাও দেখা গেছে, দিনের বেলায় শ’দুয়েক এলাকাবাসীর উপস্থিতিতে গ্রাম্য সালিশী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সালিশে গ্রাম্য মাতুব্বুরদের মধ্যে উপস্থিত থাকছেন এলাকার অনেক জনপ্রতিনিধি।
এদিকে ত্রান সহায়তা নিয়েও মিলছে অনেক অনিয়মের অভিযোগ। এলাকাভিত্তিক সুষম বন্টণ, প্রকৃত হতদরিদ্র্যদের বঞ্চিত হওয়া, ত্রাণ বিতরণে স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকা থেকে। খাবার সংকটের কারণে কর্মে ফেরার তাগাদায় ঘর হতে বের হওয়া শুরু করেছেন অনেকে।
এ আসনের সংসদ সদস্য, সাবেক ডেপুটি স্পিকার অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ মাঠে থেকে জনপ্রতিনিধিদের সাথে নিয়ে করোনা মোকাবেলা করছেন সর্বাত্মকভাবে। স্থানীয় এমপি, উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের জোরালো ভূমিকা থাকলেও দিনশেষে করোনা মোকাবিলায় চান্দিনাবাসী কতটা প্রস্তুত? এমন প্রশ্ন উঠে বার বার। তারা তাদের ব্যাপক অসচেতনতায় ঘর হতে বের হয়ে, সামাজিক লোক সমাগম সৃষ্টি করে এই উপজেলায় করোনা বিস্তারকে আরো ভয়াবহ দিকে ঠেলে দিচ্ছেন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন সচেতন মহলের অনেকে।
ঠিক এই মুর্হূতে তাদের ঘরে ফিরাতে না পারলে করোনা আক্রান্তে চান্দিনায় মৃত্যুর মিছিল ক্রমান্বয়ে দীর্ঘ হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এখানকার স্থানীয় সাংবাদিকবৃন্দ। বিভিন্ন সরকারি ভিডিও কনফারেন্সে করোনা মোকাবিলায় তাদের তরফ থেকে বলা হয়েছে, এই উপজেলার মানুষদের ঘরে ফেরাতে সেনাবাহিনীর টহল জোরদার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সপ্তাহের প্রায় সব দিনই এ উপজেলায় সেনাবাহিনী টহলের দাবি জানানো হয়েছে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে। এমন দাবির প্রেক্ষিতে কোন আশানুরূপ পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
মাননীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা প্রশাসনের নিকট আকুল আবেদন, করোনা ভাইরাসে রেড জোন খ্যাত এই চান্দিনা উপজেলায় করোনা বিস্তার রোধে এক্ষুণি কঠিন সিদ্ধান্ত দিন। প্রয়োজনে লাঠিচার্জ করে ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা করুন। লাঠিচার্জ করেও যদি এদের মৃত্যুর মিছিল থেকে দূরে রাখা যায়-তাহলে এটাই কি মঙ্গল নয়? পাশাপাশি ঘরে থাকা ও লকডাউনে থাকাদের জন্য প্রয়োজনীয় খাবারের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় নজর দিন। হতদরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের ঘরে ত্রাণ পৌছেঁ দেওয়ার কর্মযজ্ঞ বাড়িয়ে দিন। ঠিক এই মুর্হূতে কঠোর সিদ্ধান্ত ও যথাযথ ভূমিকা নিতে না পারলে চান্দিনার পুরো উপজেলায় করোনা ছড়িয়ে পড়বে ব্যাপক হারে। আর মৃত্যুর মিছিলও দিন দিন দীর্ঘ হয়ে পড়বে।
লেখক: সাদেক হোসেন, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক